পাকিস্তানে থেকে ২০ হাজার ভারতীয় সৈনিকের প্রাণ বাঁচান, চেনেন রিয়েল টাইগার রবীন্দ্র কৌশিককে?

বর্তমানে হলিউড বলিউডের সিনেমার দৌলতে আমরা সবাই গোয়েন্দা এবং গুপ্তচরের মুভি দেখে খুবই অনুপ্রাণিত হই। মনের কোনায় কোথাও একটা ইচ্ছে থাকে যে, যদি আমরাও এরকম গুপ্তচর হতে পারতাম তাহলে কেমন হতো? কিন্তু গোয়েন্দা বা গুপ্তচরের কাজ শুনতে যতটা মনোহর এবং উত্তেজনাপূর্ণ শোনায় বাস্তবের মাটিতে এটি ততটাই কঠিন এবং মারাত্মক। বিশেষ করে, যখন কাউকে এই কাজের জন্য তার ধর্ম, তার দেশ, তার নিজস্ব পরিচয় এবং তার পরিবার হারাতে হয়।

   

এমনই এক গুপ্তচর ছিলেন রবীন্দ্র কৌশিক। তার জীবন কাহিনীর ওপর তৈরি হয়েছে সলমন খানের ‘এক থা টাইগার’। তার জীবনী অনুপ্রাণিত করে হাজারো তরুণকে। তিনি এতটাই দক্ষ ছিলেন নিজের কাজে যে, একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর পদে পৌঁছে যান তিনি। বাঁচিয়ে দেন ভারতের ২০,০০০ সেনার প্রাণ। অসম্ভব অনুপ্রেরণাদায়ক তার জীবনী পড়লে মনের কোনায় জেগে ওঠে দেশপ্রেম এবং কিভাবে একজন নিজের কাজকে এতটা ভালোবেসে দেশের সুরক্ষার জন্য নিজের প্রাণকে হাসতে হাসতেই ত্যাগ করা যায়।

images

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের চিরশত্রু হয়ে পড়ে। স্বাধীন হওয়ার পরই লেগে যায় যুদ্ধ। উভয় দেশের সেনাবাহিনী প্রস্তুত ছিল হামলার জন্য। এই সময়ে, গুপ্তচরবৃত্তির কাজ একটি নতুন কাজ হিসেবে এসে দাঁড়ায়। কেন্দ্র সরকার RAW গঠনের সাথে সাথেই খুঁজতে শুরু করে ভালো গুপ্তচরের। দেশের অস্থিতিশীলতার পরিবেশের মধ্যেই রবীন্দ্র কৌশিক ১৯৫২ সালে রাজস্থানের কাছে পাকিস্তান সীমান্তের কাছের একটি শহর গঙ্গানগরে এক পাঞ্জাবি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

ravindra kaushik 1

ভারতীয় সেনাবাহিনী বা রাজনীতির কারো সাথেই রবীন্দ্র এবং তার পরিবারের কোনো সম্পর্কই ছিল না। এক সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রের মধ্যে হঠাৎ করে নাটক করার শখ হয়। অভিনয়ের ইচ্ছা পূরণ করতেই রবীন্দ্র কৌশিক জাতীয় নাট্য উপস্থাপনায় অংশ নিতে লখনউ পৌঁছেছিলেন । ততদিনে দেশে RAW এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ভালো গুপ্তচরের খোঁজ চলছে। রবীন্দ্র যে নাটকে অংশ নিয়েছিলেন তা দেখতে কিছু সেনা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এতে রবীন্দ্রর চরিত্রের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন সেনা কর্মকর্তারা।

এই নাটক দেখেই রবীন্দ্রকে RAW এজেন্সিতে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। যা রবীন্দ্র কোনোভাবেই প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি এবং এভাবেই শুরু হয় তার গুপ্তচরবৃত্তির জীবন। এরপর ১৯৭৫ সালে কৌশিককে ভারতীয় গুপ্তচর হিসেবে পাঠানো হয় পাকিস্তানে। সেখানে যাওয়ার আগে রবীন্দ্র তার পরিবারকে বিদায় জানিয়ে তার সমস্ত পুরোনো পরিচয় মুছে দিয়ে এক নতুন পরিচয় নিয়ে পাড়ি দেন সীমান্তে। পাকিস্তানে পৌঁছে রবীন্দ্র নিজের নাম পাল্টে হয়ে যান নবী আহমেদ শেখ। শুধু তাই নয় ভর্ত্তি হয়ে যান করাচির ল কলেজেও। তবে এটা শুধুমাত্র লোকদেখানোর জন্য করেননি তিনি। কলেজে থাকাকালীন নিজের এক নতুন পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৌশিক। পাকিস্তানেই আইনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছিলেন তিনি।

ravindra kaushik aka the black tiger of india image

পাকিস্তানে যাওয়ার আগে রবীন্দ্র শিখে নিয়েছিলেন উর্দু ভাষা, কিভাবে নামাজ পড়তে হয়, কুরআন পড়তে হয়। এবং এর সাথে মুসলিম রীতিনীতিও শিখেছিলেন তিনি। আইন ডিগ্রি নেওয়ার পরই রবীন্দ্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পাকিস্তানের প্রতি তার দেশপ্রেম প্রমাণ করার জন্য তিনি সৈন্যবাহিনীর প্রশিক্ষণ নেন। এই সময়ে তিনি আমানত নামে এক পাকিস্তানি মেয়ের প্রেমে পড়েন। এরপর তারা বিয়ে করেন এবং তাদের একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। এরপর ধীরে ধীরে সৈনিক থেকে মেজর পদে উন্নীত হন তিনি। নিজের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার এবং সংসারের মধ্যে থেকেও রবীন্দ্র ভারতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করে যান। বহুবার তাঁর দেওয়া তথ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করেছে। ভারতে থাকা অনেক পাকিস্তানি গুপ্তচরের তথ্যও দিয়েছেন তিনি।

রবীন্দ্র তার জীবনের প্রধান ৩০টা বছর দেশের বাইরেই কাটিয়ে দেন। এবং পাকিস্তানে থাকাকালীনই মারা যান তিনি। যদিও এতে তার নিজের কোনো দোষ ছিল না। আসলে ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর পাকিস্তান ভারতের প্রতি আরও অনেক বেশী সতর্ক হয়ে ওঠে। ভারত যখন সীমান্তে শান্তি বজায় রাখার আশা করছিল, তখন পাকিস্তান আড়াল থেকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পাকিস্তানি সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থা মিলে ভারতের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করার পরিকল্পনা তৈরি করে। কিন্তু এই পরিকল্পনা রবীন্দ্রের জানা ছিল। কারণ তিনি ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর। পরিকল্পনা অনুযায়ী, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের সেই অংশ দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, যেখানে ২০ হাজারেরও বেশি ভারতীয় সেনা মোতায়েন ছিল।

ভারতকে শিক্ষা দিতে চাওয়ার পাকিস্তানের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন রবীন্দ্র কৌশিক। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল, ততক্ষণে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনার পর পাকিস্তানি সেনারা আরো অনেক বেশী সতর্ক হয়ে যায়। তাদের সন্দেহ হয় যে, তাদের দেশে ভারতীয় গুপ্তচর রয়েছে। তাই তারা এরপর যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে। কিন্তু ঠিক এই সময় ১৯৮৩ সালে রবীন্দ্রকে সাহায্য করার জন্য আরেক ভারতীয় গুপ্তচর ইনায়েত মসীহকে পাকিস্তানে পাঠানো হয়। কিন্তু সে ধরা পড়ে যায় এবং রবীন্দ্র কৌশিকের সমস্ত তথ্য ফাঁস করে দেয়।

এরপরই রবীন্দ্র কৌশিকের আসল পরিচয় জানতে পেরে সেনা কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে যান। প্রায় সাথে সাথেই তাকে শিয়ালকোট বন্দী করা হয়। এখানে চলে তার ওপর অনেক শারীরিক মানসিক নির্যাতন করা হলেও রবীন্দ্র ভারতের বিরুদ্ধে কোনোভাবেই মুখ খোলেননি। এরপর ১৯৮৫ সালে তাকে মিয়ানওয়ালা জেলে পাঠানো হয়। এবং সেখানেই অকথ্য অত্যাচারের মধ্যে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মত যান রবীন্দ্র কৌশিক। ৩০ বছর ধরে শুধুই দেশকে সেবা করে গেছেন। বদলে চাননি কিছুই। দেশের জন্য এই গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে তাকে দিতে হয় বিরাট মূল্য। নিজের জীবন দিয়ে সেই মূল্য চোকাতে হয় তাকে।

কিন্তু আজ তিনি না থাকলেও এই দেশের প্রতিটি কোণার মানুষের মধ্যে আজীবন রয়ে যাবেন তিনি। এছাড়াও আরো অনেক গুপ্তচর রয়েছেন যাদের নিয়ে আমরা কিছুই জানিনা কিন্তু তারাও ঠিক একই ভাবে দেশকে রক্ষা করে চলেছেন সমস্ত ধরনের বিপদ থেকে।